বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা কোথায় কীভাবে?

Published: 19 Aug 2024
Md. Shahadat hosen

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল দেশ। ব্যবসায় শিক্ষা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। একটি দেশের উন্নয়নে ব্যবসা অপরিমেয় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ফলে ব্যবসার আওতা যেমন বিস্তার লাভ করেছে, তেমনই ব্যবসা বাণিজ্য শিক্ষার পরিধিও বিস্তৃত হয়েছে। এতে ব্যবসা—বাণিজ্যে সুষ্ঠু জ্ঞানের  চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাপনা নীতি ও কলাকৌশল—সংক্রান্ত জ্ঞানই ব্যবসায় শিক্ষা। এ শিক্ষা সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কাঙ্ক্ষিত খাতে বিনিয়োগ এবং অর্জিত আয়ের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষার সূচনা ব্রিটিশ আমল থেকেই। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক ব্যবসায় শিক্ষার পথ সুগম হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর সরকার বাণিজ্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। বিশেষজ্ঞরা এ সময় বাণিজ্য শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা চালু করার সুপারিশ করেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তিন স্তর বিশিষ্ট; প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে ব্যবসায় শিক্ষার তেমন কোনো বিশেষ সুযোগ নেই। এদেশে ব্যবসায় শিক্ষা শুরু হয় মূলত মাধ্যমিক স্তর থেকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যবসায় শিক্ষা অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের জেএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে দুই ধরনের বিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অধ্যয়নের সুযোগ আছে; জেনারেল ও উন্মুক্ত। উভয় ক্ষেত্রে কোর্সের ব্যাপ্তি ২ বছর। তবে সর্বোচ্চ ব্যাপ্তিকাল ৫ বছর।

উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একজন শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স (স্নাতক/ সম্মান), মাস্টার্স (স্নাতকোত্তর), ডক্টরাল প্রভৃতি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে অনার্স ডিগ্রি ৪ বছর মেয়াদি, মাস্টার্স ডিগ্রি ১/২ বছর মেয়াদি। পিএইচডি বা ডক্টরাল ডিগ্রি ৩—৫ বছর মেয়াদি হয়। এ ছাড়াও পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাসমূহে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ডিপ্লোমার মেয়াদ সাধারণত ১ বছর। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যারা ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে গ্রাজুয়েট নয়, তাদের জন্য ডিপ্লোমার মেয়াদ ১.৫ বছর হতে পারে। আবার কিছু কিছু ডিপ্লোমার ব্যাপ্তি ১ বছরের কম সময় হয়।

বাংলাদেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় সম্পর্কিত নিম্নোক্ত বিভাগসমূহ পড়ানো হয়—

  • অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস
  • ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ
  • ফিন্যান্স
  • মার্কেটিং
  • ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স
  • ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস
  • ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট
  • ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস
  • অর্গানাইজেশনাল স্ট্রাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ
  • হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট
  • ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট
  • ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং
  • এনট্রাপ্রেনিউরশিপ
  • সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট

সাধারণত ব্যবসায় শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র—ছাত্রীরা বিবিএ করতে পারে, তবে কিছু সংখ্যক মানবিক ও বিজ্ঞান শাখার ছাত্র—ছাত্রীরাও এ ডিগ্রি অর্জন করতে পারে।

যারা আইবিএ, বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে চায় তাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ, বিবিএ ও আইবিএ, এমবিএ ডিগ্রি প্রদান করে। সকল শাখার ছাত্র—ছাত্রী এতে আবেদন করতে পারে। যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএ আছে তাদের তালিকা নিচে দেওয়া হলো—

  • আইবিএ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • আইবিএ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
  • আইবিএ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  • আইবিএ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
  • পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

অ্যাকাডেমি অব বিজনেস প্রফেশনালস (এবিপি) ব্যবসায় শিক্ষাবিষয়ক একটি উদীয়মান প্রশিক্ষণ ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান। এবিপি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পিজিডি ও সার্টিফিকেশন কোর্স চালু করেছে। এসব পিজিডির ব্যাপ্তিকাল সাধারণত ৬ মাস। ইন্ডাস্ট্রি প্রফেশনালরা এসব পিজিডি করে থাকেন।

পিজিডিসমূহ:

  • পিজিডি অন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট
  • পিজিডি অন লজিস্টিক অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট
  • পিজিডি অন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট
  • পিজিডি অন ইসলামিক ফিন্যান্স প্রাকটিস
  • পিজিডি অন সফ্ট স্কিল অ্যান্ড লিডারশিপ ডিভেলোপমেন্ট
  • পিজিডি অন রিস্ক অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ম্যানেজমেন্ট
  • পিজিডি অন সেলস অ্যান্ড ডিজিটাল মার্কেটিং

এবিপিতে পিজিডি ছাড়াও বিভিন্ন সার্টিফিকেট কোর্স চালু আছে। সার্টিফিকেট কোর্সগুলো নিম্নরূপ—

  • সার্টিফিকেট অন ইসলামিক ব্যাংকিং প্রডাক্ট
  • সার্টিফিকেট অন এসএমই এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ
  • সার্টিফিকেট অন ইসলামিক ফিনান্সিয়াল মডেল
  • সার্টিফিকেট অন ডিজিটাল মার্কেটিং
  • সার্টিফিকেট অন ওয়ারহাউস অ্যান্ড ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট
  • সার্টিফিকেট অন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি
  • সার্টিফিকেট অন ইসলামিক ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড সুকুক
  • সার্টিফিকেট অন ফিন্যান্স ফর নন ফিনান্সিয়াল ম্যানেজার
  • সার্টিফিকেট অন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়াশন

এ সকল সার্টিফিকেট কোর্স সাধারণত ২ মাস মেয়াদি হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট ব্যবসায়বিষয়ক বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এসব প্রশিক্ষণ কোর্সে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। এ সকল প্রশিক্ষণ কোর্স সাধারণত স্বল্পমেয়াদি হয়। যেমন : ৫—৭ দিন।

স্কিটি নিম্নোক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে

  • নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন
  • বুক কিপিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং
  • হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট
  • ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লায়েন্স ম্যানেজমেন্ট
  • এসএমই ম্যানেজমেন্ট
  • অফিস ম্যানেজমেন্ট
  • এক্সপার্ট মার্কেটিং

ইসলামিক ফিনান্সের এর জন্য বাংলাদেশে ইসলামিক ফিন্যান্স একাডেমি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানটি (আইএফএসি) বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

এসব প্রশিক্ষণে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহ নিম্নরূপ :

  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন সুকুক (২.৫ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ইসলামিক ব্যাংকিং (২.৫ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ইসলামিক ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্স (৬ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ই—কমার্স অ্যান্ড শরিয়াহ্ (৬ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ফ্যামিলি ইকোনমিকস অ্যান্ড কনজুগাল লাইফ (৫ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ইসলামিক ফিনান্সিয়াল কন্ট্রাক্ট (৬ মাস)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ইসলামিক প্রফেশনালস অ্যাকাউন্টান্টস (শুধু অ্যাকাউন্টান্টস ও অডিটর করতে পারে, (৫ মাস মেয়াদি)
  • সার্টিফিকেট কোর্স ইন ইসলামি ইকোনমিক্স প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্রাকটিস (৬ মাস)

বিআইবিএমএ বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম চালু আছে। এগুলো মূলত ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য ট্রেইনিং প্রোগ্রাম। এসব প্রোগ্রামের মধ্যে আছে—

  • সার্টিফায়েড ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফিন্যান্স প্রফেশনালস (২৮ সপ্তাহ)
  • সার্টিফায়েড এক্সপার্ট ইন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (৯ মাস)
  • সার্টিফায়েড এক্সপার্ট ইন ক্রেডিট ম্যানেজমেন্ট (৬ মাস)
  • সার্টিফায়েড এক্সপার্ট ইন ট্রেড সার্ভিসেস (৬ মাস)
  • সার্টিফায়েড এক্সপার্ট ইন ই—ব্যাংকিং (৬ মাস)
  • সার্টিফায়েড এক্সপার্ট ইন অ্যান্টি—মানিলাউন্ডারিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল ক্রাইম (৬ মাস)

মাস্টার্স শেষ করার পর অনেকেই উচ্চতর গবেষণার জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন স্তরে পিএইচডি করতে পারে। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩—৫ বছর মেয়াদে পিএইচডি ডিগ্রি করতে পারে।

পিএইচডি সাধারণত অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারের জন্য করা হয়। পিএইচডি ছাড়াও ডিবিএ করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে ৩—৫ বছর সময় লাগতে পারে। DBA সাধারণত প্রফেশনাল ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন।

উপরোক্ত ডিগ্রিসমূহ ছাড়াও কেউ প্রফেশনাল লেবেলে CA (Chartered Account), CMA (Cost and Management Accounting) প্রভৃতি পেশাগত ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। এক্ষেত্রে CA ডিগ্রি প্রদান করে CAB এবং CMA ডিগ্রি প্রদান করে CMAB প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়াও চার্টার্ড সেক্রেটারিজ সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারে। এটি প্রদান করে CSB । এ সকল প্রফেশনাল কোর্সে সাধারণত গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ বর্তমানে প্রকট বেকার সমস্যার প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য দ্রুত শিল্পায়ন ও ব্যবসায় উন্নয়ন আবশ্যক। দক্ষ ব্যবস্থাপক ও শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ব্যবসায় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দেশের শ্রমবাজারে ব্যবসায় শিক্ষা গ্রাজুয়েটদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল এবং ব্যবসায় শিক্ষায় উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও গবেষক দরকার।

আরিফুল ইসলাম

লেখক: সহকারী অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Newsroom Image
Like 2